স্বর্গ সুধার বিপরীতে
আবদুস সাত্তার| আপডেট: ০২:৫৬, এপ্রিল ১৪, ২০১৪
অজানাকে জানা, আর অজয়কে জয় করার প্রবৃত্তি নিয়েই মানুষের জন্ম। জ্ঞান অন্বেষণের এই বাসনা ছিল বলেই দূর দেশে এসেছি একথা নিশ্চিত করে বলতে পারি না। তবে এ পরবাসে আত্মার স্বাধীনতা ম্লান হয়েছে, ক্ষীণ হয়েছে প্রাণের স্পন্দন এ কথা সহজেই বলতে পারি। আমার ছেলেবেলা কেটেছে অনন্ত যৌবনা মেঘনার পারে, অগণিত নিরন্ন মানুষের ভিড়ে । শীতের মৌসুমে ছয় আনা দামের মায়ের কিনে দেয়া লাল রাবারের জুতা মনে যে বিচিত্র অনুভূতির জন্ম দিয়েছে, সন্দেহ হয় নবাব সিরাজের হাজার টাকা দামের দু পাটি নাগরাও তাকে সে শিহরণ দিতে পারতো কি না। এমনি করে দিন গেছে, গেছে মাস, বছর গড়িয়ে এসেছে। তারুণ্যের চপলতা আর সোনালী সুখের নেশায় একদিন আসতে চেয়েছি সুদূর আমেরিকায়। খরচের প্রশ্নেই বিপত্তি। এত টাকা কোথায়? বাবা বললেন “বর্গা জমির স্বল্প আয়ে টিকিটের সংকুলান সম্ভব নয়”। মা বললেন “আমার হাতের বালা খুলে নাও, ছেলেকে মানুষ হতে হবে”। ১৯৮৩ সাল। ওকলাহোমার এক বিশ্ববিদ্যালয়। এখানেই আমরা কজন বাংলাদেশের ছাত্র-ছাত্রী। সারা সপ্তাহের ক্লাস সেরে সপ্তাহ শেষে একশো মাইল দূরে ডালাস যাই চাকরি করতে। শনি, রবি দুদিনের জন্য রুম ভাড়া করা আছে ডালাসে। একই রুমে বেশ কয়েকজন। একটু অসুবিধা হলেও পয়সা বাঁচানোর তাগিদে আমরা তা মেনে নেই। ওকলাহোমা থেকে ডালাস, প্রতি যাত্রীর তেল খরচ দুই ডলার। গাড়ির মালিকের কোনো তেল খরচ নেই। আমরা তাতেই ধন্য। গাড়ির মালিকও আমাদের সাহায্য করে স্বস্তিবোধ করেন। সোজা কথা নয়। গাড়ি কিনতে মঞ্জু ভাইকে প্রায় দুই হাজার ডলার খরচ করতে হয়েছে। উকিল মামার গাড়ির দাম কোনদিন জানা হয়নি। সপ্তাহ শেষের এ চাকরির মধ্যে কেউ রুমবয়, কেউ কুক, কেউবা হোটেলের ক্লার্ক। ডিস ওয়াসার হয়েই আমি ছিলাম ধন্য। মনে অনেক আশা। আমার মায়ের সোনার বালার সুরাহা একদিন অবশ্যই হবে। আমেরিকা। রঙিন এ দেশ। সাজানো এর সংসার। অতি সন্তর্পণে প্রাচুর্য দিয়ে নাগরিক সাজিয়ে নিয়েছে তাদের আবাস ভূমি। পড়াশুনার শেষে চাকরি আর মেলে না। সঙ্কোচ আর ব্যর্থতার মাঝে আমি যেন হারিয়ে যাই। নিজের অগ্রগতি আর পারিবারিক প্রত্যাশার মধ্যে ব্যবধান বেড়ে চলে দিন দিন। সুখ আসে না। নতুন করে আবার স্বপ্ন দেখি। সুখের নেশায় আমি ছুটে চলি দূর হতে দুরান্তরে, মিসিসিপি পার হয়ে আরও বহুদূরে। চাকুরির আশায় ছুটে চলি টেনেসি প্রদেশে। কলারাডোর পাহাড় চুড়ায় দেখি শুভ্র তুষারের মেলা। মার্ক টোয়েনের সমাধিতে খুঁজে পাই ইতিহাসের ছোঁয়া। তবুও তৃষ্ণা মেটে না। আমার মন মিশে রয় বাংলাদেশের কৃষকের লাঙ্গলের ফলায় আর দোয়েল পাখির মৃদু গুঞ্জনে। মন ছুটে যায় অবারিত হলুদ সরিষা ক্ষেতের পাশে আমার বীরাঙ্গনা বোনের সমাধিতে; সর্পিল আকারে চলে যাওয়া মেঠো পথের পাশে সুখন আলীর কুঁড়েঘরে। মন ছুটে চলে কিষাণীর রঙিন স্বপ্নে আর কঠিন মাটির তলে শায়িত মায়ের পাশে। এমনি করে এগার বছর কেটে যায়। ১৯৯৭ সনের কথা। একদিন এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চাকরির ডাক আসে। সেই থেকে শুরু আজ আমি সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে কর্মরত। ইতিমধ্যে আমার লেখা ছোট গল্পের একখানা বই আমেরিকা থেকে প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশে ২০১৩ সনের হে বই মেলা আর দৈনিক পত্রিকায় এর উল্লেখ আছে; আরও উল্লেখ আছে আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ক্লাসে। হে স্বজন প্রবাস যদি হয় স্বর্গ সুধার মতো তার বিপরীতে আছে প্রাণের হুতাশ। জীবিকার প্রয়োজনেই আমরা কজন এখানে। প্রবাসে- দেশের মানুষ আর মাতৃভূমি প্রতিদিনই আমাদের ঋণী করে তুলে। এই ঋণ কোনদিনই শোধ হবার নয়। অনেকদিন পরে স্মরণ করেছো বন্ধু। তোমাদের কি দিই বলো! তোমাদের জন্য রইলো আমাদের ভালোবাসা আর সারা বেলার স্বপ্ন এবং সত্য, শোভন, কল্যাণ। যুক্তরাষ্ট্র (লেখার আই.ডি : ৩৫)